আমার বউকে এখন আর ভালো লাগে না।হ্যা, সাথী,
আমার দেড় বছরের বিবাহিতা স্ত্রী। মেয়েটা
বেশ লক্ষি,চুপচাপ।আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।
ওর এই মিনমিনে স্বভাব দেখেই ওকে পছন্দ
হয়েছিল।দেখতে আহামরি সুন্দর না হলেও মায়াবী
চেহারা। ওকে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিন
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,ওর জীবনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি? সে আমাকে
বলেছিল,পরিবার।বেশ খুশিই হয়েছিলাম সেদিন।
যাক,সংসারী এক বউ পাওয়া গেল।তবে সে একটা
অনুরোধ করেছিল,আমি যেন তাকে চাকুরী
করতে দেই।আমি না করিনি,করুক না চাকুরী। বরং
ঘরে বসে কিটি পার্টি করার থেকে
চাকুরীজীবী মেয়ে আমার বেশি পছন্দ।
.
সেদিনই আমাদের আকদ হয়ে গেল।একসপ্তাহ পর
বৌভাত করে সাথীকে ঘরে তুল্লাম। আমি চাকুরী
শুরু করার পর থেকেই আলাদা মেসে থাকি,অফিস
দূরে তাই। বিয়ের পর দুজনের অফিসের দূরত্ব
হিসেব করে নিজেই মাঝামাঝি একটা বাসা নিয়ে সংসার
শুরু করলাম। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই
টের পেলাম সাথী শুধু সংসারী মেয়ে
না,অতিমাত্রায় পতিভক্ত স্ত্রী। মনে মনে বেশ
পুলকিত হলাম।সাড়ে পাঁচ বছরের মেস জীবন পার
হওয়ার পর যেন পারিবারিক জীবনের সুখ পাচ্ছি।
.
সারাদিন ক্লান্তিকর অফিস শেষে বাসায় ফেরার পর
যখন দেখি বাথরুমে তোয়ালে-লুংগি আগে
থেকেই রাখা।সাথে গরম পানিটাও,কার না ভালো
লাগে? গোসলের পর বের হতেই
দেখি,টেবিলে সন্ধ্যার নাস্তা রেডি।নাস্তার পর আমি
প্রতিদিন ছোট্ট একটা ন্যাপ নেই,হয়ত
২০-৩০মিনিটের।শরীরটা ভীষন চাঙা লাগে।কিছুক্ষন
টিভি দেখি,বা ইন্টারনেটে ব্রাউজ করি।
.
একসময় সাথী ডাকে,ডিনার রেডি। সুখী সুখী
চেহারা
করে বউকে দেখলাম,নাহ, মেয়েটা লক্ষি আছে।
ওর
রান্নাও অনেক ভালো।ও বেশিরভাগ দিনেই
অফিসের কাপড় না চেঞ্জ করেই খেতে বসে।
আচ্ছা সমস্যা নাই।খাওয়ার পর ছাড়লেই হবে!রাতে
শোয়ার আগে এককাপ চা,সাথী মেয়েটা আমার সব
জানে।কত খেয়াল রাখে! আমি চা খেতে খেতে
ও গোসল সেরে নেয়।মাঝে মাঝে আমি ওকে
কাছে টানি। ও কখনো না করেনা, কত লক্ষি বউ
আমার। আমি প্রতিদিন সুখের সাগরে ভাসতে লাগলাম।
এমন সুখী দাম্পত্য জীবন সবাই পায়না!
.
সকালে অফিসের জন্য আমরা একসাথে বের হই,
এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।ভরপেটে নাস্তা
করে,সাথে লাঞ্চবক্স নিয়ে বের হতে
নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।সাথে বউ
থাকে, আহ জীবনে আর কি লাগে?সাথী অবশ্য
সবসময় লাঞ্চ নেয় না! কেন নেয় না কি জানি?
অফিসে যাওয়ার পর দুই-তিন বার ফোন দেয় ও।
খেয়েছি কিনা,খাবার গরম ছিল কিনা খোঁজ নেয়।আহ
আমার বউটা কত কেয়ারিং!
.
সবই ভালো চলছিল,কিন্তু ইদানীং ওকে আমার আর
ভালো লাগে না!গত দেড় বছর ধরে একই রুটিন,
একই জীবন।এমনকি ঘুরতে যাওয়াও হতো রুটিন
করে,মাসে একবার।সাথী কখনো ঘুরতে যেতে
চায়না, আমিও যাইনা...এভাবেই চলছিল।কিন্তু আমি প্রায়ই
একটা কম্প্যানিওন মিস করি,যার সাথে কথা বলা যায়।
অফিসের কথা, বাজারের কথা, রাস্তাঘাটের
কথা,রাজনীতির কথা,খেলার কথা,প্রিয় মুভির কথা!
মাঝে মাঝে কারো সাথে নিজের জীবনের
ছোট-বড় ঘটনা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছা
করে,সুখ-দুঃখের আলাপ করতে ইচ্ছা করে।
ইদানীং মনে হয় সাথীকে বিয়ে করে অনেক
ভুল করেছি।ওর মত মেয়েরা ভালো সংসারী হয়,
কিন্তু সংগী হতে পারেনা।
.
গত দেড় বছরে ওর সাথে টানা ১০মিনিট কথা বলেছি
কিনা মনে পড়ে না।এভাবে কি একটা সম্পর্ক টেনে
নেয়া যায়?আমি মনে হয় ওকে কখনো ভালবাসিনি,তা
না হলে এমন চিন্তা কেমন করে মাথায় আসে।ওর
সাথে আমার সম্পর্কটা পুরোপুরি জৈবিক, খাওয়া, ঘুম
আর শরীরের টান।আচ্ছা, সাথীও কি এমন ভাবে?
.
সাথীর যে মিনমিনে স্বভাব দেখে ওকে বিয়ে
করেছিলাম, সেটা এখন রীতিমত আমাকে প্যারা
দিচ্ছে।পুরো জীবনটাই বোরিং হয়ে গেছে।
আসলে আমরা কেউ কারো জন্য উপযুক্ত না।
এভাবে চলা যায় না...আরে ভাই,মনেরও তো একটা
ব্যাপার আছে,নাকি?মনের চাওয়া বলে কিছু নেই? গত
দেড় বছর ধরে অফিস টাইমে ফোন করে একই
কথা, খাবার নিয়েই!!খেয়েছি কিনা,গরম কিনা..... আচ্ছা,
খাবার ছাড়া কথা বলার আর কিছু নেই?আমি যদি না
খাই,এসে খাইয়ে দিয়ে যাবে? নাকি গরম না থাকলে
এসে গরম করে খাওয়াবে?ভাল্লাগেনা এই জীবন।
.
কাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি।সেদিন কাজের চাপে
লাঞ্চ করা হয়নি।রাস্তায় সেদিন প্রচুর জ্যাম কোন ভি
আই পি যাচ্ছিলেন বোধহয়।কপাল খারাপ থাকলে যা হয়
আর কি! প্রায় দুই কিলো হেঁটে বাসায় পৌঁছলাম।একে
তো ক্ষুধায় জান যায় অবস্থা,তার উপর হেঁটে এসে
পায়ে ব্যথা!বাসায়ফিরে সাথীকে লাঞ্চবক্স দিয়ে
গোসলে গেলাম।বের হতেই সাথী জিজ্ঞাসা
করলো,তুমি আজ লাঞ্চ করোনি?
আমি বললাম, না,করিনি।
-তাহলে দুপুরে বললে যে করেছো?
আমি এবার হিতাহিত জ্ঞান হারালাম, ক্ষোভের সাথেই
বললাম, খালি লাঞ্চ লাঞ্চ লাঞ্চ,খাবার খাবার!! তোমার
কাছে এগুলি ছাড়া আর কোন কথা নেই?
.
সাথী চুপ করে আছে।ওর চুপ থাকাটা আমার কাছে
অসহ্য লাগছে,রাগের মাথায় বলে বসলাম,তোমার
এই মিনমিনে স্বভাব আমার অসহ্য লাগে সাথী।আমি
তোমাকে শুধু বাসার কাজের জন্য বিয়ে করিনি।
আমারো তো একটা মানসিক চাহিদা আছে, আমারো
তো কারো সাথে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করে!
কিন্তু তুমি সেরকম নও!শুধুই কি শারীরিক চাহিদাটাই
আসল?নাকি "খেয়েছি কিনা" "খাবার গরম" কিনা এইসব
ফালতু কথা আসল? বলো আমাকে!! বলো?
.
সাথী আশ্চর্য রকম শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় জিজ্ঞাসা
করলো, তোমার কথা শেষ?আর কিছু বলবে?
আমি বিশাল রকম ধাক্কা খেলাম।আমি কখনো ওর এমন
কণ্ঠস্বর শুনিনি!এবার চিৎকার না করে বললাম, সাথী,
তোমার সাথে আমি নিজেকে মানাতে পারছিনা।আমি
মনের সুখ পাচ্ছিনা। আমার খুব একা লাগে!
সাথী সেই শান্ত স্বরেই বললো, তোমার কি
ধারনা, আমি মিনমিনে তাই আমার কথা বলতে ইচ্ছা
করেনা?
.
শোন,প্রথমত আমি মিনমিনে নই, আমি কথা কম বলি।
দ্বিতীয়ত, কম কথা বলা মানে এই না যে, আমার
মনের চাহিদা নেই!
-- কিন্তু তুমি তো....
-- তোমার একা লাগে? কখনো কি আমার সংগ
চেয়েছ বলো তো?চাকুরী তুমিও করো, আমিও
করি।সারাদিন অফিস শেষে তুমিও ক্লান্ত থাকো,
আমিও থাকি।কখনো কি এসে বলেছো,সাথী
গোসল সেরে নাও,আজ বাইরে থেকে নাস্তা
কিনে এসেছি?
-- কিন্তু এখানে আমার দোষ কোথায়?
-- দোষ কোথায়? আমি প্রতিদিন বাসায় ফিরে, রান্না
করি,কোটাবাছা করি,ধোয়া পালা করি...আমার কষ্ট হয়না?
তোমার তো আবার ন্যাপ না নিলে হয়না, আর আমি
তো রাতের আগে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেও পারিনা!
কখনো এসে বলেছ, সাথী, রান্না পরে করো,
আসো আমরা টিভি দেখি।অথবা, কখনো এসে
রান্নাঘরে ঢুকে বলেছ,সাথী দাও দেখি
প্লেটগুলো ধুয়ে দেই?? বলেছ?
.
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি,এই মেয়েটার
মনে এত কথা জমে আছে?এত কষ্ট?আমি চুপ
করে আছি।সাথী বলেই যাচ্ছে, আমি তোমার
সাথে কথা বলিনা,তোমার একা লাগে...কখনো কি
রাতে আমাকে কাছে না টেনে জিজ্ঞাসা
করেছো, আমার অফিসে আজ কি কি হলো? অথবা
আমাকে কখনো জিজ্ঞাসা করেছ, আমার আদৌ
কাছে আসতে ইচ্ছা করছে কিনা?
-- তোমার যদি আপত্তি থাকতো, আমাকে বললেই
পারতে, আমি কি জোর করতাম?
-- জানিনা তো জোর করতে কিনা! আমি কি
তোমাকে চিনি? না তুমি আমাকে চেন? আমরা কি
নিজেদের কখনো একে অপরের কাছে প্রকাশ
করার সুযোগ পেয়েছি?
.
নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে! সাথী একটা কথাও
তো ভুল বলছে না,তাহলে আমিই কি দুঃখবিলাসী?
-- আর খাবারের কথা বলছো? লাঞ্চ করেছো
কিনা,খাবার গরম কিনা? তুমি এতেই বিরক্ত হয়ে যাও!
কিন্তু কখনো কি আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা
করেছ, আমি লাঞ্চ করেছি কি না? বা আমি লাঞ্চ নিয়ে
গেছি কিনা?
-- তুমি ফোন করো দেখেই তো আমি ফোন
করিনা! আর আমি জানি,তুমি রেগুলার লাঞ্চ নাও না!!
-- কেন নেই না?
-- জানিনা!
-- জানার কথাও না! লাঞ্চে ভাত খেলে আমার ঘুম
পায়,তাই অফিস থেকে হাল্কা নাস্তা এনে খাই!তাছাড়া
আমি ফোন করলেই যে তোমার ফোন করা
নিষেধ, তা তো না তাইনা?
.
সাথী আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না।
রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানাচ্ছে।
রাতের খাবার ও রুটিনমত খেলাম।শুয়েও পড়লাম।আমরা
দুইজনই দুইদিন ফিরে শুয়ে আছি, কিন্তু বুঝতে পারছি,
যে দুইজনই সজাগ।
.
সকালে উঠে আবার সেই নিয়মমতো অফিস।কিন্তু
আশ্চর্যজনকভাবে আজ সারাদিন সাথীর কোন
ফোন এলোনা!আমিও যে খুব অপেক্ষা
করেছিলাম, তা না! তবে কোথায় যেন "কি নেই,কি
নেই "একটা ভাব!কালকের সাথীর বলা কথাগুলো
মাথায় ঘুরছে।আসলেই তো তাই, আমি "মনের মানুষ
মনের মানুষ " করে নিজেকে দুঃখী ভাবছি,অথচ
আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে আমি সবসময়
দূরে রেখেছি!আমিই তো আমাদেরকে কাছাকাছি
হওয়ার কোন সুযোগ দেইনি! ওকে একটু অবসর
দিলে সময়টা আমরা দুজনেই পেতাম!প্রচন্ড
অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতর!
প্রচন্ড....
.
আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি,সাথীও মাত্র
এলো।কাল থেকে ওর সাথে কোন কথা হয়নি।
এখনো ওর মুখ থমথমে হয়ে আছে।আমি ওকে
জিজ্ঞাসা করলাম,বেশি ক্লান্ত?
সাথী ক্লান্তভাবে বললো,নাহ।গোসল সেরে
আসো,নাস্তা দিচ্ছি।
-- নাস্তা লাগবে না,আমার সাথে এসো।
ঘন্টায় রিক্সা ভাড়া করলাম, সাথী আমাকে অবাক হয়ে
দেখছে।রিক্সায় উঠে আমি সাথীর হাত ধরে আছি।
সন্ধ্যা নেমে গেছে।আমি বললাম, তোমাকে কিছু
কথা বলি?
সাথী কিছু বললো না,মাথা নাড়লো।
-- তোমাকে বিয়ের সময় তোমার অনুরোধ ছিল
যেন,তোমাকে চাকুরী করতে দেই।ব্যাপারটা
আমার খুব ভালো লেগেছিল।কারন স্বাবলম্বী
মেয়েদের আমি সম্মান করি।কিন্তু বিয়ের পর
তোমার আমাকে "পতিদেব" মানার মনোভাব আমার
মনে অন্যরকম সুখ এনে দিয়েছিল। শত হলেও
পুরুষ তো! এবং আমরা এখানেই ভুলটা করি!
স্ত্রীদের নিজের কেনা দাসী ভাবতে থাকি।
কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কখনো পতিপরমেশ্বর
হতে চাইনি।সবসময় একজন অর্ধাঙ্গিনী চেয়েছি।
কিন্তু কিভাবে তা পাবো, তাই জানতাম না! আমি যদি
তোমার বেটার হাফ না হতে পারি, তবে কিভাবে আসা
করবো তুমি আমার বেটার হাফ হবে,তাইনা?
.
সাথী বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝতে
পারছিনা, ও কি ভাবছে!আমি ওর হাতটা আরেকটু শক্ত
করে ধরে বললাম, আমি তোমার "সত্যি সত্যি বেটার
হাফ" হওয়ার চেষ্টা করবো।কিন্তু আমার একটা শর্ত
আছে!
সাথী আমার দিকে ফিরে তাকালো।তার চোখে
জিজ্ঞাসা।আমি বললাম, কাল যে রণমূর্তি
দেখিয়েছো, সেটা সারাজীবন দেখাবে!
ওকে?
সাথী ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, সেটা
রণমূর্তি ছিল বুঝি?
.
-- হ্যা, তবে এই মূর্তিটাকে আমার ভালো
লেগেছে।আসলে মনে হয়, আমি এই
মূর্তিটাকেই ভালোবাসি।
সাথী এবার আমার হাতটাও শক্ত করে ধরলো।রিক্সা
চলছে।আমরা গুটুরগুটুর গল্প করছি।আমি ১০টা কথা
বলছি,সাথী ১টা। চলছে এভাবে, চলুক না! তাওতো
চলছে...
আমার দেড় বছরের বিবাহিতা স্ত্রী। মেয়েটা
বেশ লক্ষি,চুপচাপ।আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।
ওর এই মিনমিনে স্বভাব দেখেই ওকে পছন্দ
হয়েছিল।দেখতে আহামরি সুন্দর না হলেও মায়াবী
চেহারা। ওকে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিন
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,ওর জীবনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি? সে আমাকে
বলেছিল,পরিবার।বেশ খুশিই হয়েছিলাম সেদিন।
যাক,সংসারী এক বউ পাওয়া গেল।তবে সে একটা
অনুরোধ করেছিল,আমি যেন তাকে চাকুরী
করতে দেই।আমি না করিনি,করুক না চাকুরী। বরং
ঘরে বসে কিটি পার্টি করার থেকে
চাকুরীজীবী মেয়ে আমার বেশি পছন্দ।
.
সেদিনই আমাদের আকদ হয়ে গেল।একসপ্তাহ পর
বৌভাত করে সাথীকে ঘরে তুল্লাম। আমি চাকুরী
শুরু করার পর থেকেই আলাদা মেসে থাকি,অফিস
দূরে তাই। বিয়ের পর দুজনের অফিসের দূরত্ব
হিসেব করে নিজেই মাঝামাঝি একটা বাসা নিয়ে সংসার
শুরু করলাম। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই
টের পেলাম সাথী শুধু সংসারী মেয়ে
না,অতিমাত্রায় পতিভক্ত স্ত্রী। মনে মনে বেশ
পুলকিত হলাম।সাড়ে পাঁচ বছরের মেস জীবন পার
হওয়ার পর যেন পারিবারিক জীবনের সুখ পাচ্ছি।
.
সারাদিন ক্লান্তিকর অফিস শেষে বাসায় ফেরার পর
যখন দেখি বাথরুমে তোয়ালে-লুংগি আগে
থেকেই রাখা।সাথে গরম পানিটাও,কার না ভালো
লাগে? গোসলের পর বের হতেই
দেখি,টেবিলে সন্ধ্যার নাস্তা রেডি।নাস্তার পর আমি
প্রতিদিন ছোট্ট একটা ন্যাপ নেই,হয়ত
২০-৩০মিনিটের।শরীরটা ভীষন চাঙা লাগে।কিছুক্ষন
টিভি দেখি,বা ইন্টারনেটে ব্রাউজ করি।
.
একসময় সাথী ডাকে,ডিনার রেডি। সুখী সুখী
চেহারা
করে বউকে দেখলাম,নাহ, মেয়েটা লক্ষি আছে।
ওর
রান্নাও অনেক ভালো।ও বেশিরভাগ দিনেই
অফিসের কাপড় না চেঞ্জ করেই খেতে বসে।
আচ্ছা সমস্যা নাই।খাওয়ার পর ছাড়লেই হবে!রাতে
শোয়ার আগে এককাপ চা,সাথী মেয়েটা আমার সব
জানে।কত খেয়াল রাখে! আমি চা খেতে খেতে
ও গোসল সেরে নেয়।মাঝে মাঝে আমি ওকে
কাছে টানি। ও কখনো না করেনা, কত লক্ষি বউ
আমার। আমি প্রতিদিন সুখের সাগরে ভাসতে লাগলাম।
এমন সুখী দাম্পত্য জীবন সবাই পায়না!
.
সকালে অফিসের জন্য আমরা একসাথে বের হই,
এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।ভরপেটে নাস্তা
করে,সাথে লাঞ্চবক্স নিয়ে বের হতে
নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।সাথে বউ
থাকে, আহ জীবনে আর কি লাগে?সাথী অবশ্য
সবসময় লাঞ্চ নেয় না! কেন নেয় না কি জানি?
অফিসে যাওয়ার পর দুই-তিন বার ফোন দেয় ও।
খেয়েছি কিনা,খাবার গরম ছিল কিনা খোঁজ নেয়।আহ
আমার বউটা কত কেয়ারিং!
.
সবই ভালো চলছিল,কিন্তু ইদানীং ওকে আমার আর
ভালো লাগে না!গত দেড় বছর ধরে একই রুটিন,
একই জীবন।এমনকি ঘুরতে যাওয়াও হতো রুটিন
করে,মাসে একবার।সাথী কখনো ঘুরতে যেতে
চায়না, আমিও যাইনা...এভাবেই চলছিল।কিন্তু আমি প্রায়ই
একটা কম্প্যানিওন মিস করি,যার সাথে কথা বলা যায়।
অফিসের কথা, বাজারের কথা, রাস্তাঘাটের
কথা,রাজনীতির কথা,খেলার কথা,প্রিয় মুভির কথা!
মাঝে মাঝে কারো সাথে নিজের জীবনের
ছোট-বড় ঘটনা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছা
করে,সুখ-দুঃখের আলাপ করতে ইচ্ছা করে।
ইদানীং মনে হয় সাথীকে বিয়ে করে অনেক
ভুল করেছি।ওর মত মেয়েরা ভালো সংসারী হয়,
কিন্তু সংগী হতে পারেনা।
.
গত দেড় বছরে ওর সাথে টানা ১০মিনিট কথা বলেছি
কিনা মনে পড়ে না।এভাবে কি একটা সম্পর্ক টেনে
নেয়া যায়?আমি মনে হয় ওকে কখনো ভালবাসিনি,তা
না হলে এমন চিন্তা কেমন করে মাথায় আসে।ওর
সাথে আমার সম্পর্কটা পুরোপুরি জৈবিক, খাওয়া, ঘুম
আর শরীরের টান।আচ্ছা, সাথীও কি এমন ভাবে?
.
সাথীর যে মিনমিনে স্বভাব দেখে ওকে বিয়ে
করেছিলাম, সেটা এখন রীতিমত আমাকে প্যারা
দিচ্ছে।পুরো জীবনটাই বোরিং হয়ে গেছে।
আসলে আমরা কেউ কারো জন্য উপযুক্ত না।
এভাবে চলা যায় না...আরে ভাই,মনেরও তো একটা
ব্যাপার আছে,নাকি?মনের চাওয়া বলে কিছু নেই? গত
দেড় বছর ধরে অফিস টাইমে ফোন করে একই
কথা, খাবার নিয়েই!!খেয়েছি কিনা,গরম কিনা..... আচ্ছা,
খাবার ছাড়া কথা বলার আর কিছু নেই?আমি যদি না
খাই,এসে খাইয়ে দিয়ে যাবে? নাকি গরম না থাকলে
এসে গরম করে খাওয়াবে?ভাল্লাগেনা এই জীবন।
.
কাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি।সেদিন কাজের চাপে
লাঞ্চ করা হয়নি।রাস্তায় সেদিন প্রচুর জ্যাম কোন ভি
আই পি যাচ্ছিলেন বোধহয়।কপাল খারাপ থাকলে যা হয়
আর কি! প্রায় দুই কিলো হেঁটে বাসায় পৌঁছলাম।একে
তো ক্ষুধায় জান যায় অবস্থা,তার উপর হেঁটে এসে
পায়ে ব্যথা!বাসায়ফিরে সাথীকে লাঞ্চবক্স দিয়ে
গোসলে গেলাম।বের হতেই সাথী জিজ্ঞাসা
করলো,তুমি আজ লাঞ্চ করোনি?
আমি বললাম, না,করিনি।
-তাহলে দুপুরে বললে যে করেছো?
আমি এবার হিতাহিত জ্ঞান হারালাম, ক্ষোভের সাথেই
বললাম, খালি লাঞ্চ লাঞ্চ লাঞ্চ,খাবার খাবার!! তোমার
কাছে এগুলি ছাড়া আর কোন কথা নেই?
.
সাথী চুপ করে আছে।ওর চুপ থাকাটা আমার কাছে
অসহ্য লাগছে,রাগের মাথায় বলে বসলাম,তোমার
এই মিনমিনে স্বভাব আমার অসহ্য লাগে সাথী।আমি
তোমাকে শুধু বাসার কাজের জন্য বিয়ে করিনি।
আমারো তো একটা মানসিক চাহিদা আছে, আমারো
তো কারো সাথে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করে!
কিন্তু তুমি সেরকম নও!শুধুই কি শারীরিক চাহিদাটাই
আসল?নাকি "খেয়েছি কিনা" "খাবার গরম" কিনা এইসব
ফালতু কথা আসল? বলো আমাকে!! বলো?
.
সাথী আশ্চর্য রকম শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় জিজ্ঞাসা
করলো, তোমার কথা শেষ?আর কিছু বলবে?
আমি বিশাল রকম ধাক্কা খেলাম।আমি কখনো ওর এমন
কণ্ঠস্বর শুনিনি!এবার চিৎকার না করে বললাম, সাথী,
তোমার সাথে আমি নিজেকে মানাতে পারছিনা।আমি
মনের সুখ পাচ্ছিনা। আমার খুব একা লাগে!
সাথী সেই শান্ত স্বরেই বললো, তোমার কি
ধারনা, আমি মিনমিনে তাই আমার কথা বলতে ইচ্ছা
করেনা?
.
শোন,প্রথমত আমি মিনমিনে নই, আমি কথা কম বলি।
দ্বিতীয়ত, কম কথা বলা মানে এই না যে, আমার
মনের চাহিদা নেই!
-- কিন্তু তুমি তো....
-- তোমার একা লাগে? কখনো কি আমার সংগ
চেয়েছ বলো তো?চাকুরী তুমিও করো, আমিও
করি।সারাদিন অফিস শেষে তুমিও ক্লান্ত থাকো,
আমিও থাকি।কখনো কি এসে বলেছো,সাথী
গোসল সেরে নাও,আজ বাইরে থেকে নাস্তা
কিনে এসেছি?
-- কিন্তু এখানে আমার দোষ কোথায়?
-- দোষ কোথায়? আমি প্রতিদিন বাসায় ফিরে, রান্না
করি,কোটাবাছা করি,ধোয়া পালা করি...আমার কষ্ট হয়না?
তোমার তো আবার ন্যাপ না নিলে হয়না, আর আমি
তো রাতের আগে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেও পারিনা!
কখনো এসে বলেছ, সাথী, রান্না পরে করো,
আসো আমরা টিভি দেখি।অথবা, কখনো এসে
রান্নাঘরে ঢুকে বলেছ,সাথী দাও দেখি
প্লেটগুলো ধুয়ে দেই?? বলেছ?
.
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি,এই মেয়েটার
মনে এত কথা জমে আছে?এত কষ্ট?আমি চুপ
করে আছি।সাথী বলেই যাচ্ছে, আমি তোমার
সাথে কথা বলিনা,তোমার একা লাগে...কখনো কি
রাতে আমাকে কাছে না টেনে জিজ্ঞাসা
করেছো, আমার অফিসে আজ কি কি হলো? অথবা
আমাকে কখনো জিজ্ঞাসা করেছ, আমার আদৌ
কাছে আসতে ইচ্ছা করছে কিনা?
-- তোমার যদি আপত্তি থাকতো, আমাকে বললেই
পারতে, আমি কি জোর করতাম?
-- জানিনা তো জোর করতে কিনা! আমি কি
তোমাকে চিনি? না তুমি আমাকে চেন? আমরা কি
নিজেদের কখনো একে অপরের কাছে প্রকাশ
করার সুযোগ পেয়েছি?
.
নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে! সাথী একটা কথাও
তো ভুল বলছে না,তাহলে আমিই কি দুঃখবিলাসী?
-- আর খাবারের কথা বলছো? লাঞ্চ করেছো
কিনা,খাবার গরম কিনা? তুমি এতেই বিরক্ত হয়ে যাও!
কিন্তু কখনো কি আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা
করেছ, আমি লাঞ্চ করেছি কি না? বা আমি লাঞ্চ নিয়ে
গেছি কিনা?
-- তুমি ফোন করো দেখেই তো আমি ফোন
করিনা! আর আমি জানি,তুমি রেগুলার লাঞ্চ নাও না!!
-- কেন নেই না?
-- জানিনা!
-- জানার কথাও না! লাঞ্চে ভাত খেলে আমার ঘুম
পায়,তাই অফিস থেকে হাল্কা নাস্তা এনে খাই!তাছাড়া
আমি ফোন করলেই যে তোমার ফোন করা
নিষেধ, তা তো না তাইনা?
.
সাথী আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না।
রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানাচ্ছে।
রাতের খাবার ও রুটিনমত খেলাম।শুয়েও পড়লাম।আমরা
দুইজনই দুইদিন ফিরে শুয়ে আছি, কিন্তু বুঝতে পারছি,
যে দুইজনই সজাগ।
.
সকালে উঠে আবার সেই নিয়মমতো অফিস।কিন্তু
আশ্চর্যজনকভাবে আজ সারাদিন সাথীর কোন
ফোন এলোনা!আমিও যে খুব অপেক্ষা
করেছিলাম, তা না! তবে কোথায় যেন "কি নেই,কি
নেই "একটা ভাব!কালকের সাথীর বলা কথাগুলো
মাথায় ঘুরছে।আসলেই তো তাই, আমি "মনের মানুষ
মনের মানুষ " করে নিজেকে দুঃখী ভাবছি,অথচ
আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে আমি সবসময়
দূরে রেখেছি!আমিই তো আমাদেরকে কাছাকাছি
হওয়ার কোন সুযোগ দেইনি! ওকে একটু অবসর
দিলে সময়টা আমরা দুজনেই পেতাম!প্রচন্ড
অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতর!
প্রচন্ড....
.
আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি,সাথীও মাত্র
এলো।কাল থেকে ওর সাথে কোন কথা হয়নি।
এখনো ওর মুখ থমথমে হয়ে আছে।আমি ওকে
জিজ্ঞাসা করলাম,বেশি ক্লান্ত?
সাথী ক্লান্তভাবে বললো,নাহ।গোসল সেরে
আসো,নাস্তা দিচ্ছি।
-- নাস্তা লাগবে না,আমার সাথে এসো।
ঘন্টায় রিক্সা ভাড়া করলাম, সাথী আমাকে অবাক হয়ে
দেখছে।রিক্সায় উঠে আমি সাথীর হাত ধরে আছি।
সন্ধ্যা নেমে গেছে।আমি বললাম, তোমাকে কিছু
কথা বলি?
সাথী কিছু বললো না,মাথা নাড়লো।
-- তোমাকে বিয়ের সময় তোমার অনুরোধ ছিল
যেন,তোমাকে চাকুরী করতে দেই।ব্যাপারটা
আমার খুব ভালো লেগেছিল।কারন স্বাবলম্বী
মেয়েদের আমি সম্মান করি।কিন্তু বিয়ের পর
তোমার আমাকে "পতিদেব" মানার মনোভাব আমার
মনে অন্যরকম সুখ এনে দিয়েছিল। শত হলেও
পুরুষ তো! এবং আমরা এখানেই ভুলটা করি!
স্ত্রীদের নিজের কেনা দাসী ভাবতে থাকি।
কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কখনো পতিপরমেশ্বর
হতে চাইনি।সবসময় একজন অর্ধাঙ্গিনী চেয়েছি।
কিন্তু কিভাবে তা পাবো, তাই জানতাম না! আমি যদি
তোমার বেটার হাফ না হতে পারি, তবে কিভাবে আসা
করবো তুমি আমার বেটার হাফ হবে,তাইনা?
.
সাথী বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝতে
পারছিনা, ও কি ভাবছে!আমি ওর হাতটা আরেকটু শক্ত
করে ধরে বললাম, আমি তোমার "সত্যি সত্যি বেটার
হাফ" হওয়ার চেষ্টা করবো।কিন্তু আমার একটা শর্ত
আছে!
সাথী আমার দিকে ফিরে তাকালো।তার চোখে
জিজ্ঞাসা।আমি বললাম, কাল যে রণমূর্তি
দেখিয়েছো, সেটা সারাজীবন দেখাবে!
ওকে?
সাথী ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, সেটা
রণমূর্তি ছিল বুঝি?
.
-- হ্যা, তবে এই মূর্তিটাকে আমার ভালো
লেগেছে।আসলে মনে হয়, আমি এই
মূর্তিটাকেই ভালোবাসি।
সাথী এবার আমার হাতটাও শক্ত করে ধরলো।রিক্সা
চলছে।আমরা গুটুরগুটুর গল্প করছি।আমি ১০টা কথা
বলছি,সাথী ১টা। চলছে এভাবে, চলুক না! তাওতো
চলছে...
No comments:
Post a Comment