Wednesday, December 27, 2017

Luck

রবি বলল
- ভাইয়া আর বেশি সময় নেই। তুমি তাড়াতাড়ি করে
পাঞ্জাবী পড়ে নিচে আসো।
ওর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে।
আমার এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
- সাদা পাঞ্জাবী পড়ো। আমি যাই।
কথাটি বলে রবি আমার রুম থেকে চলে গেলো।
আলমারিতে পাঞ্জাবী রাখা। আমার পাশের টুকু দোলা
সবসময় লক না করে রাখে। যাতে যখন যা
প্রয়োজন হয় সহজে বের করে নিতে পারি।
আলমারি খোলার সাথে সাথে ২য় তাকে একটা চিরকুট
পেলাম।
সাদা কাগজ চার ভাজ করে রাখা।ভাজ খুলে দেখলাম
দোলার হাতের লিখা।
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা
- জানো ডাক্তার আপু বলেছে " আমাদের যমজ
বাচ্চা হবে। " মেয়ে না ছেলে হবে সেটা পরে
বলবো।
- ইতি তোমার দোলা।
চিরকুট টা ওয়ালেটে রাখলাম।
আলমারির তাকে ৬-৭ টা পাঞ্জাবী। সবই দোলার
পছন্দ। সাদা রঙের পাঞ্জাবী ওর খুব পছন্দ।
একটা পাঞ্জাবীও আমার পড়া হয়নি। আমার পাঞ্জাবী
পড়তে ভালো লাগেনা। বিয়ের দিন তো খুব
জোড় করে পড়ানো হয়েছিলো আমাকে।
প্রতি ইদে ও আমার জন্য পাঞ্জাবী কিনতো। কিন্তু
আমার আর পড়া হয়নি। ও এই ব্যাপার টা নিয়ে বেশ
অভিমান করতো।
সাদা পাঞ্জাবী পড়ে আবার চিরকুট টা বের করলাম।
লিখাগুলো আবার পড়লাম।
দরজায় কে যেন নক করছে। জিজ্ঞেস করলাম
- কে?
- ভাইজান আমি রোজি।দরজাটা খোলেন।
দরজা খুলে দিলাম।
রোজির হাতে সাদা কাপড়ে মোড়া কিছু একটা আমার
দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
- ভাবীর কিছু জিনিষ পত্র ছিলো....
হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর রোজি চলে গেলো।
কাপড় টা বিছানায় রেখে মোড়ানো খুললাম।
একজোড়া নুপুর, নাক ফুল, দুটো চুড়ি আর কানের
দুল।
নুপুর জোড়া হাতে নিলাম। শুকনো লাল রক্ত,
রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে।
নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে।
বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। কেউ আর এই
নুপুর পড়ে শব্দ করে হাঁটবে না।
আমাকে বিরক্ত করার জন্য ও ইচ্ছে করে বেশি
বেশি শব্দ করতো।
নুপুরটা অনেক পুরোনো। রূপা ক্ষয় হয়ে
গেছে কিছু জায়গায়। কতোবার বলেছি
- দোলা, নতুন একজোড়া নুপুর বানালেই পারো।
ও হেসে জবাব দিয়েছে
- নতুন বানালেও, আমি এটাই পড়বো।
- কেনো? এমনকি আছে এতে?
- তুমি না সবকিছু ভুলে যাও। এটা তোমার দেয়া প্রথম
উপহার।
- আচ্ছা তাহলে আমি নিজে বানিয়ে এনে দিবো।
তারপরও এই পুরানটা পড়তে পারবে না।
- না,সিব্বির। আমি এটাই পড়বো।
একদিন,
রাতে ল্যাপটপে জরুরী কাগজপত্র গুলো
দেখছিলাম। ও জানালার ধারে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে
চাঁদ দেখছিলো।
আমি বললাম
- মন খারাপ বুঝি?
- না তো।
- তাহলে এতো চুপচাপ?
- এখানে একটু আসো না।
আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে রেখে ওর পাশে দাঁড়ালাম।
- কী কিছু বলবে?
- আচ্ছা তুমি আমাকে আগের মতো সময় দাও না
ক্যান?
- ব্যবসা টা কে সামাল দিতে হচ্ছে একাই। বাবা আর
পারেন না।
- তারপরও একটু সময় কি হয়না?
উত্তর আর দিতে পারিনি।
তারপর দোলাই বলল
- দেখো একদিন তোমার সময় থাকবে কিন্তু আমিই
থাকবো না।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম
- ধুর পাগলী। এসব বলে না।
জিনিষ গুলো আলমারিতে রেখে দিলাম।
রুম থেকে বের হলাম। কান্নাকাটির আওয়াজ কানে
ভেসে আসছে। নিচে নামছি আর শব্দ ততো
তীব্র হচ্ছে।
একটা জায়গায় বেশ ভির। আমাকে দেখে বাবা ছুটে
এলো।
- এতো দেরি করে কেউ?
আমি কিছুই বললাম না। কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই।
বাবা আমার হাত ধরে টেনে ভিরের মধ্যে নিয়ে
গেলো। সবাই সরে পড়লো।
আর বলতে লাগলো
- এই সরে দাড়া দোলার স্বামী এসেছে।
স্টিলের খাটে সাদা কাফনে জড়িয়ে রেখেছে
আমার দোলাকে।
চোখে সুরমা, নাকে তুলা। ঠোঁটে কাটা দাগ স্পষ্ট
হয়ে আছে। ডান দিকে কাত করা ওর মুখখানা।
এতো সুন্দর লাগছে ওকে। ওকে ঘুমন্ত অবস্থায়
সবথেকে বেশি সুন্দর লাগে।
বিদ্রুপের হাসি হাসছে।
বলছে - দেখো সিব্বির, আমি আর নেই। এখন
কেউ তোমার কাছে সময় চাবে না। কেউ বলবে
না, তুমি আর আগের মতো নেই।তুমি আমায় আর
ভালবাসো না।
আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী তে জরুরী মিটিং
পড়ে যায়।
মিটিং শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়।
বাসার দরজা খুললো মা।
আমাকে দেখে বলল
- বউ আজকে খায়নি।
আমি বললাম
- কেনো? কী হয়েছে?
মা রাগী স্বরে বলল
- আজকে বিবাহবার্ষিকী তোদের। আজকের দিন
তো অন্ততপক্ষে একসাথে রাতে ডিনার করতে
পারতি!
রুমে ঢুকে লাইট জ্বালালাম। বিয়ের শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ে
আছে।
ও সাজগোজ করতে খুব পছন্দ করে।আজকে
অনেক সেজেছে।
৩ বছরের সম্পর্কের পর পরিবারের মতেই
আমাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের পর ব্যবসা নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম
যে ওকে সময় দিতে পারতাম না।
ছোট মামী এসে বাবাকে বলল
- দুলাভাই আছরের ওয়াক্তে জানাজা নামাজ। আজান
দিয়ে দিবে এখনি।
আমার কানে কথা গুলো যাচ্ছে।
আমি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি
- আর কিছুক্ষণ, মাত্র কয়েকটা মিনিট। তারপর
বিদায়বেলা।
অভিমানী মেয়ে, অভিমান করে চলে গেলো।
বাবা বলল
- খাট কাঁধে নিবি না?
- হুম।
গতকাল দুপুরবেলা আমি অফিসের কাজে বের
হবো। তখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বললাম
- মহারাণী কিছু বলবে মনে হচ্ছে?
- অনেকদিন ঘুরতে যাই না। চলো না একটু ঘুরে
আসি।
- দোলা,এই অবস্থায় বাইরে কম যাওয়াই ভালো।
- প্লিজ সিব্বির। ঘরে বসে থাকতে থাকতে আমি
বোর হয়ে গেছি।
- আমার অফিসে জরুরী কাজ আছে।
- আমার বিকাল ৪ টায় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
চলোনা আজকে একসাথে যাই।
- দোলা, আমি তোমাকে ড্রপ করে দেই। পরে
আরেকদিন আমি যাবো।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
- আমি একাই যেতে পারবো।
কথাটা বলে ও রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর দোলার চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি
দৌড়ে গিয়ে দেখি। দোলা উপর হয়ে মেঝের
উপর পরে আছে। মেঝে রক্তে ভেসে
যাচ্ছে।
তারপর বাবা এম্বুলেন্স ডেকে আনলেন।
ওটি তে নেয়া হলো।কয়েক ঘণ্টা পর ওটি
থেকে বের হয়ে
ডাক্তার আপু বললেন
- একটা বাচ্চা মারা গেছে। আরেকটি বেঁচে
আছে। আর মায়ের অবস্থা ভালো না।
প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এমনিতেই ৭ মাসে ডেলিভারি
হয়েছে তার উপর এতো বড় এক্সিডেন্ট।
তার পরের দিন,
সকাল ১০ টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো।
আর ফিরলো না। রাগ করে রুম থেকে চলে
গেলো আর ফিরলো না।
মৃতা কন্যাকে ওর পাশে শুইয়ে দিলো। ওকেও
কাফনের কাপড় পড়ানো হয়েছে।
মা - মেয়েকে কতো একসাথে শুয়ে থাকতে
কতো সুন্দর লাগছে।
জীবিত কন্যাকে ইনকিউবিটরে রাখা হয়েছে।
আজকে আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি অনেকদিন পরে
বাসার বাইরে। ঘুরতে না, চিরদিনের জন্য রেখে
আসতে গোরস্থানে।
আফসোস হচ্ছে আমার, যদি ওকে না রাগিয়ে দিতাম
তাহলে ও এভাবে চলে যেতো না। আর এই
ঘটনাও ঘটতো না।
দোলা, তোমার একাকীত্ব টা আমি বুঝিনি। তুমি
অনেকবার আমাকে বলেছো। আমি বুঝতে চাই নি।
তুমি আমাকে কাছে চেয়েছো, খুব কাছে।
প্রত্যেকটা আনন্দ, দুঃখের মুহূর্ত তুমি আমার সাথে
ভাগ করে বাঁচতে চেয়েছো।
কিন্তু আমি ভাগটা নিতে পারিনি। তাই তুমি চলে গেলে
চিরদিনের জন্য।

No comments:

Post a Comment